লেখক: নূর হোসেন মাজিদী
পর্ব ২- সকল ইসলামী সূত্রের অভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী নবী করীম (সাঃ) নির্ধারিত দিবসে নাজরানের খৃস্টান ধর্মনেতাদের সাথে পারস্পরিক অভিসম্পাতের জন্যে বহির্গত হবার সময় শুধু হযরত ফাতেমা (আঃ), হযরত আলী (আঃ), হযরত ইমাম হাসান (আঃ) ও হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-কে সাথে নেন এবং বের হবার পূর্বে এ চারজনকে একটি চাদর দিয়ে ঢেকে নিয়ে আল্লাহর নিকট দোআ করেন তাতে তাঁদেরকে তিনি “আমার আহলে বাইত” বলে উল্লেখ করেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত খৃস্টান ধর্মনেতারা অভিসম্পাতের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
আহলে বাইতের বিষয়টি যেহেতু আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ছিল তাই এ ব্যাপারে উম্মাহাতুল মু’মিনীন অর্থাৎ নবী করীম (সাঃ) এর স্ত্রীগণের তাতে অন্তর্ভূক্ত না হতে পারার কারণে কোন ক্ষোভ বা অসন্তুষ্টি ছিল না। সাহাবায়ে কেরাম (আঃ) এ ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত ছিলেন।
মোদ্দাকথা, হযরত ফাতেমা (আঃ) যে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকেই নারীকুল শিরোমণি ও নারীকুলের চূড়ান্ত আদর্শরূপে মনোনীত ছিলেন তা এক বিতর্কাতীত ব্যাপার।
হযরত ফাতেমা (আঃ) এর জীবনকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য হাসিল, মানবজাতির কল্যাণে অবদান রাখা এবং আদর্শরূপে নিজেকে উপস্থাপনের জন্যে দীর্ঘায়ূ কোনো শর্ত নয়। হযরত ফাতেমা (আঃ) তাঁর স্বল্পকালীন জীবনেই আদর্শ কন্যা, আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মাতা ও আদর্শ নারীরূপে তাঁর যথাযথ ভূমিকা পালন করে গেছেন্। তিনি সুখে, দুঃখে ও সংগ্রামে সর্বাবস্থায় ছায়ার মত নবী করীম (সাঃ)-এর পাশে ছিলেন। এ কারণে তাঁকে “উম্মে আবিহা” অর্থ্যাৎ “তাঁর পিতার মা” বলে উল্লেখ করা হতো।
তাঁকে স্ত্রী বা পুত্রবধূ করার জন্য আরবের ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নবী করীম (সাঃ) তা গ্রহণ করেন নি, বরং হযরত ফাতেমা (আঃ) এর বর হিসাবে হযরত আলী (আঃ) কে বেছে নেন যিনি ছিলেন ইসলামের শ্রেষ্ঠতম সন্তান, যিনি কখনোই শির্ক্ করেন নি, পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন, যিনি ছিলেন জ্ঞানের নগরীরূপ নবী করীম (সাঃ) এর জ্ঞানের দরজা এবং বীরত্ব, সাহসিকতা, ন্যায়পরায়ণতা ও ধার্মিকতায় সকলের শ্রেষ্ঠ।
হযরত ফাতেমা (আঃ) ছিলেন আদর্শ মাতা। তিনি তাঁর তিন সন্তান হযরত ইমাম হাসান (আঃ), হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) ও হযরত যায়নাব (আঃ) কে এমনভাবে গড়ে রেখে যান যে, তাঁরা ইসলামের ইতিহাসে সিদ্ধান্তকর ও দিকনির্দেশক ভূমিকা পালন করেন।
ইয়াকুবী ও মাস’উদীসহ অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, হযরত ফাতেমা যাহরা (আঃ) হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর নবুওয়াতে অভিষিক্ত হবার পর পঞ্চম বছরে ২২শে, মতান্তরে ২০শে জমাদিউস সানী তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। নবী করীম (সাঃ)-এর মি’রাজের পরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন বলেও বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত আছে। (এ থেকে মনে হয়, মি’রাজের ঘটনা নবুওয়াতের চতুর্থ বছরে হয়ে থাকবে।) এসব হাদীস অনুযায়ী নবী করীম (সাঃ) মি’রাজে গমন করে বেহেশতে একটি বিশেষ ফল ভক্ষণ করেন, এরূপ ফল পৃথিবীতে নেই। তাঁর পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের পরে এ ফলেরই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে হযরত ফাতেমা (আঃ) মাতৃগর্ভে আগমন করেন।
হাদীস অনুযায়ী হযরত নবী করীম (সাঃ) তাঁর নাম রাখেন “ফাতেমা” যার অর্থ “যাকে আলাদা করে রাখা হয়েছে বা দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে”। যেহেতু তিনি অন্য সমস্ত নারী থেকে আলাদা মর্যাদার অধিকারী তাই তাঁকে এ নাম দেয়া হয়েছে। হযরত ইমাম জা’ফর সাদেক (আঃ) বলেছেন, তাঁকে এ কারণে “ফাতেমা” বলা হয়েছে যে, তিনি সকল প্রকার নৈতিক ও চারিত্রিক কদর্যতা থেকে দূরে ছিলেন। নবী করীম (সাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীস অনুযায়ী হযরত ফাতেমা (আঃ)-কে এবং যারা তাঁকে অনুসরণ করেন তাঁদেরকে দোযখের আগুন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে বলে তাঁকে এ নাম দেয়া হয়েছে।
হযরত ফাতেমা (আঃ) তাঁর বিভিন্ন গুণের কারণে বহু উপাধির অধিকারিণী ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে সিদ্দিকাহ্ (সত্যবাদিনী), মুবারাকাহ্ (বরকতময়), তাহেরাহ্ (পবিত্রা), যাকীয়াহ্ (পরিশুদ্ধতার অধিকারিণী), রাযীয়াহ্ (সন্তুষ্ট), মার্যীয়াহ্ (সন্তুষ্টপ্রাপ্ত), মুহাদ্দিসাহ্ (হাদিস বর্ণনাকারিণী) ও যাহরা (প্রোজ্জ্বল)।
ইবনে হিশাম, ইবনে শাহর আশূব, আল্লামা মাজলিসী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহিম) এবং আরও অনেক ইতিহাসবিদ, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির হযরত ফাতেমা (আঃ)-এর আরও কতগুলো গুণবাচক উপাধির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি হযরত ফাতেমা যাহরা (আঃ) নামেই সর্বাধিক সুপরিচিতা।
হযরত ফাতেমা যাহরা (আঃ)-এর প্রতিটি নামেরই বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য রয়েছে যা মুসলিম নারীদের জন্য অনুকরণীয় সর্বোত্তম আদর্শরূপে তাঁকে উপস্থাপন করেছে। নারীকুল যাতে তাঁকে অনুসরণের মাধ্যমে সর্বোত্তম পূর্ণতা ও আল্লাহ্ তা’আলার নিকট মহান মর্যাদার অধিকারী হতে পারে সে লক্ষ্যেই তাঁকে নারীকুলের জন্য আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহস্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছে।
নারীকুল শিরোমণি হযরত ফাতেমা (আঃ) জ্ঞান, তাকওয়াহ-পরহেযগারী, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, সাহস, ধৈর্য, কষ্ট-সহিষ্ণুতা, দায়িত্ববোধ ও অন্য সমস্ত উত্তম গুণের প্রতিমূর্তি ছিলেন এবং এসব দিক দিয়ে তিনি শুধু সমগ্র নারীকুলেরই আদর্শ ছিলেন না, বরং পুরুষদের জন্যও তাঁর জীবন জ্ঞান ও শিক্ষার এক বিরাট উৎস। এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা কেবল স্বতন্ত্রভাবে ও সুপরিসর ক্ষেত্রেই সম্ভবপর।
হযরত ফাতেমা (আঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর ওফাতের অল্পকাল পরে হিজরী ১১ সালে ইন্তেকাল করেন। জন্মতারিখ সম্পর্কে মতপার্থক্যের কারণে ওফাতকালে তাঁরা বয়স সম্পর্কেও মতপার্থক্য হয়েছে। নবুওয়াতের পঞ্চম বছরে জন্মের তারিখ সঠিক গণ্য করা হলে তিনি ১৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ওফাতের তারিখ সম্বন্ধেও মতভেদ আছে। নবী করীম (সাঃ)-এর ওফাতের ৪০, ৭৫ বা ৯০ দিন পরে অথবা ৬ মাস পরে হযরত ফাতেমা (আঃ) ইন্তেকাল করেন। কোন কোন সূত্রে সুনির্দিষ্টভাবে ১৪ই জমাদিউল উলার কথা বলা হয়েছে। তাঁকে মদীনা শরীফের জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়। (সমাপ্ত)